Blogs, philosophy

ব্লগ কেন লিখি

কেন ব্লগ লিখি? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে মনে ভেসে ওঠে কয়েকটা সাল যেগুলো এই লেখালেখির পেছনে তাগিদ যুগিয়েছিল। প্রধান কারণগুলোর মধ্যে থাকবে খানিকটা বিষাদ, খানিকটা লেখালেখির চিরকালের চাপা ইচ্ছা, কিছু অসামান্য অভিজ্ঞতা আর একটা খুন। হ্যাঁ খুনও, তবে সে প্রসঙ্গে আসবো যথাসময়ে। 

ছোটবেলা থেকেই বইয়ের পোকা হবার সুত্রে বিভিন্ন ধরনের লেখার সাথে পরিচয় হয়েছে বহুদিন ধরে। স্কুলে দেখতাম বন্ধুরা কবিতা গল্প লিখছে, স্কুলের পত্রিকায় ছাপাও হচ্ছে সেসব লেখা। মনে একরকম হিংসা থেকেই লেখার চেষ্টা করেছি কয়েকবার স্কুল জীবনে কিন্তু সে লেখা নিজে পড়ে নিজেরই পাতে দেবার যোগ্য নয় বলে মনে হয়েছে। আরো একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছিলাম, কোন কাজ অন্যের থেকে দেখে হুবহু নকল করা বা সেই কাজকে ইম্প্রোভাইজ করে আরো নিখুঁত বানানো যতটা সহজ লাগে আমার, ততটাই কঠিন নিজে ভেবে কোন কিছু সম্পূর্ণ নতুন কিছু সৃষ্টি করা, তা সে গল্প কবিতাই হোক বা ছবি, গান, সুর। তাই ম্যাপ আঁকা যত সহজ মনে হয় আমার, তার চেয়ে ঢের কঠিন ঠেকে একটা কুকুর আঁকা। এসব থেকে একটা ধারনা মনে বদ্ধ হয়ে গেছিল যে আমি তেমন সৃষ্টিশীল (ক্রিয়েটিভ) নই।

সে তো হল কিন্তু কেবল সৃষ্টিশীল মানুষেই যে লেখালেখি করে তা তো নয়। কাজের বা উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে রিপোর্ট লেখা এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, সেই রিপোর্ট লিখতে গিয়ে দেখলাম লেখার ধরনধারন মন্দ নয় আর যতটা সম্ভব ব্যাকরণে তেমন ভুলভ্রান্তিও নেই, অনেক ক্ষেত্রে এমনও হয়েছে যে নিজের লেখা পড়ে নিজেই চমকে গেছি। সেই থেকে ইচ্ছা জেগেছিল গল্প কবিতার মত ক্রিয়েটিভ কিছু না পারলেও প্রবন্ধ, কোন ঘটনার বিবরন ইত্যাদি লেখার। কিন্তু কি নিয়ে লিখবো তা নিয়ে প্রচুর দ্বন্দ্ব ছিল মনে, তাই দুএকটা National Geographic এর তথ্যচিত্রের বিবরন লেখা ছাড়া তেমন কিছুই লেখালেখি করা হয়নি।

বাড়িতে কম্পিউটার কেনার পর হাতে যখন পর্যাপ্ত সময়, দিনরাত আড্ডা মেরেও কাটছেনা, তখন দেখলাম দু চারজন বন্ধু ব্লগ বলে কি একটা লেখা শুরু করেছে। হুজুগে পড়ে একটা অ্যাকাউন্টও খুলে ফেললাম কিন্তু লেখা কিছুই হল না, যাকে বলে হাতে রইল পেনসিল। লেখা শুরু হল ২০০৭ এ যখন MBA পড়ার জন্য লেখার মান বাড়ানোর চাপ শুরু হল। হাবিজাবি বিষয় নিয়ে লিখে ফেললাম বেশ কয়েকখানা ব্লগ। ২০০৮ এর দু তিনটে লেখা মনে ধরল বেশ, লেখাগুলো অনেক সময় অতীতের স্মৃতিচারণ না হয় মনের ভাবনা, কিন্তু লেখার গতির চেয়ে মনে ধরল ভাবনা চিন্তাগুলো যেগুলো বেশ অ্যাবস্ট্র্যাক্ট বলা যেতে পারে, lateral ভাবনার একটা ছোঁয়া ছিল ব্লগগুলোয়। ঠিক যেই সময় লেখাতে একটা ভরবেগ (momentum) আসছে সেই সময় চাঁটিবাঁটি গুটিয়ে রওনা দিলাম বিলেতে, পড়ার আর চাকরি খোঁজার চাপে মাথায় উঠল লেখালেখি। অবসর সময় বরাদ্দ হল ফুটবল আর নেট-এ সিনেমা গান ইত্যাদি।

২০১০ সালটা অবশ্যই থাকবে লেখালেখি শুরু করার পেছনে রসদ জোগানোর জন্য। এই বছর শুরুর দিকে নতুন চাকরি জয়েন করলাম, মাথায় যে আকাশছোঁয়া বেতনের অলীক স্বপ্ন ঘুরছিল, সেটা শেষে ভেঙে চুরমার হল। পড়তে আসার সময় আত্মীয়রা জিজ্ঞেস করত কবে ফেরত যাবো, আমিও খুব জোরগলায় বলতাম এই পড়ার ধার শোধ হতে যতদিন লাগে দু তিন বছর এই যা। চাকরি শুরু করার পর দেখলাম পুরো আট বছরই লাগবে সব ঋণ শোধ করতে। তারপর কিছু সঞ্চয় করে ফেরত যেতে যেতে প্রায় বারো চৌদ্দ বছর। এই বহুদিন প্রবাসে থাকার কথা ভেবে ফ্রাস্ট্রু খেয়ে অবসর সময় মনে করার চেষ্টা করতাম হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো—কুস্টিয়া জলপাইগুড়ি এসপ্ল্যানেড কলেজ স্ট্রীট।

পুরনো দিনগুলোকে এক জায়গায় সঞ্চয় করার ইচ্ছাটা এই সময়েই শুরু হয়। মনে হচ্ছিল স্মৃতিশক্তি তেমন জোরাল নেই আর, তাই ভুলে যাবার আগেই সব ঘটনাগুলোকে কোথাও লিখে রাখাটা দরকার। ২০১০ এর শেষের দিকে দুর্গাপুজায় বাড়ি গিয়ে সেই তাগিদ চরমে উঠল, ফিরে এলাম একরাশ স্মৃতি আর মনখারাপ নিয়ে, তবে সেইসাথে রীতিমত বদ্ধপরিকর হয়ে বাক্সভর্তি চার-পাঁচখানা ডাইরী আর গুচ্ছের জেল পেন সঙ্গে নিয়ে এলাম ডাইরীতে সব পুরনো স্মৃতিগুলোকে লিখবো বলে। তখনো জানতামনা যে সংসারী হব কিনা কোনদিন তবে মনে হত যেভাবে দিন বদলাচ্ছে হুহু করে, আমি জীবনে যা সব দেখেছি সেসব এখন একমাত্র মাথার মধ্যে ছাড়া হয়ত তার আর কোন চিহ্নই নেই। জানিনা কে পড়বে এইসব পুরনো দিনের লেখা কিন্তু অনেকটা ভবিষ্যতের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকেই ঠিক করলাম মনে যে সব ছোটবড় স্মৃতিগুলো জমে আছে সেগুলো লিখে রাখবো যাতে বয়সের সাথে এসব হারিয়ে না যায়। হয়তো অন্যদের চেয়ে আমার নিজের জন্যই শুরু করেছিলাম লেখাগুলো, যাতে পরে ভুলে গেলেও ডাইরী থেকে সেই মনিমুক্তোগুলো পুনরুদ্ধার করা যায়। বেশ তোড়জোড় করে লিখলাম কয়েক পাতা তারপর আবার যে কে সেই, সব উত্তেজনা নিমেষে উধাও। তবে রয়ে গেল ডাইরীগুলো মাঝে মাঝেই মনে করিয়ে দেবার জন্য যে এটা একটা প্রকল্প ছিল যেটা এখনো শুরু করা যায়।

২০১৩ য় বিয়ের আগে আর পরে আমি আর জেনিফার অনেক জায়গায় ঘুরতে গেছিলাম আর সেই সুত্রে Tripadvisor এ বেশ কিছু রিভিউ লিখলাম হয় জায়গা না হয় রেস্টুরেন্টদের নিয়ে। সেটা চালিয়ে যাবার ইচ্ছা ২০১৪তে থাকলেও আমাদের জীবনে সোফিয়া আসার পর সময় শক্তি কোনটাই তেমন অবশিষ্ট ছিলনা। তবে তাগিদ একটা রয়ে গেছিল সব সময় যে সংসারের সাথে সাথে নিজের ব্যক্তিগত সময়টাও বজায় রাখা। ১৪র শেষের দিকে আবার সেই ইচ্ছাটা প্রবল হল, আর অনেক বিস্তারিত ভাবে লেখার পরিকল্পনা তৈরি হল – ভ্রমনের অভিজ্ঞতা ডাইরীতে আর Tripadvisor এ, অতীতের স্মৃতিগুলো ২০১০ এ কেনা সেই ডাইরীগুলোয়। এই প্ল্যানে লেখা মানেই বিবরণ, আবার সেই রিপোর্ট, বিষয়ভিত্তিক কোন কিছু নিয়ে ভাবনাচিন্তা করে লেখার কোন ইচ্ছা তখনো জাগেনি। তবে নিজে হাতে ডাইরীতে লেখা বা Schaeffers, Mont Blanc জাতীয় কলম ব্যবহারের আশা যতটা ছিল, আমার অখাদ্য হাতের লেখা যা অনেক সময় আমি নিজেই পড়তে পারিনা সেটা অন্যে কিভাবে পড়বে সেই চিন্তা করে অন্য মাধ্যম নিয়েও চিন্তাভাবনা শুরু করেছিলাম যেমন ব্লগ বা নিদেনপক্ষে কম্পিউটারে টাইপ করা। লেখা শুরুও হয়েছিল পুরোদমে, প্রথমে বিভিন্ন বেড়ানোর বিবরন দিয়ে নতুন কেনা ডাইরীতে। তবে আগেও যা হয়েছে, প্রচুর উদ্যম নিয়ে শুরু করলেও মাঝপথেই আবার ইতি হয়ে গেল যখন কাজের চাপে নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড় হল।

যে কারনে লেখাটা শুরু করেছিলাম কিছু সালের কথা দিয়ে, তার প্রধান কারন হল ২০১৫ সাল যা লেখালেখির উৎসাহ উদ্দীপনা প্রেরণা সব কিছুর মুলে। ফেব্রুয়ারীর মাঝের দিকে গেলাম ফ্রান্স। অনেকদিনের আকাঙ্খা স্বপ্ন জড়িয়ে ছিল ফ্রান্স নিয়ে তাই সব খুঁটিনাটি বর্ণনা আর সেই বহুকালের জমে থাকা ইচ্ছেগুলো মনের থেকে মুক্ত করে কোথাও স্থায়ীভাবে জমা করাটা ছিল বাঞ্ছনীয়। সুতরাং আবার শুরু হল লেখা আর মাধ্যম যদিও প্ল্যানমাফিক হবার কথা ভ্রমনের ডাইরী, শেষে ঠিক করলাম ব্লগ, আর সাত বছর বাদে জুড়লো আরো দুখানা লেখা সেই পুরনো অ্যাকাউন্টে। সেখানেই হয়তো থেমে যেতাম, কিন্তু একটা মর্মান্তিক ঘটনা সব প্ল্যান পরিকল্পনা ঘেঁটে দিল।

তারিখটাও মনে আছে, ২৬শে ফেব্রুয়ারী। ফ্রান্স যাত্রার ব্লগ সবে শেষ করেছি এমন সময় দেখি ফেসবুক উত্তাল ঢাকায় ঘটে যাওয়া এক সাম্প্রদায়িক খুন নিয়ে। নিহতের পরিচিতি তিনি ব্লগার, তাঁর লেখায় তিনি সব ধর্মের কুফল কুসংস্কার নিয়ে তুলোধোনা করতেন। বাস্তবিকভাবেই গোঁড়া অন্ধবিশ্বাসী অজ্ঞ কিছু লোকের কাছে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বিষফোঁড়ার মত তাই তাঁকে চুপ করানো বা পুরো দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেবার পুন্যলাভের পিপাসু শহীদ পাওয়া বিরল ছিলনা। অভিজিৎ রায়কে আমি চিনতাম না, জীবিতাবস্থায় তাঁর লেখা হয়তো চোখে পড়ে থাকবে কিন্তু মনে গেঁথে থাকার মত কিছু মনে পড়ছেনা। সব ধর্মের প্রতি সমান অবজ্ঞা অবিশ্বাস থেকেই অনুভব করলাম অভিজিৎ যেমন ছিলেন তীব্র সোচ্চার বিরোধী, শুধু ধর্মই নয় অনেক প্রাতিষ্ঠানিক জড়দ্গবতাই তিনি ঝেড়ে ফেলতে বদ্ধপরিকর হয়েছিলেন বাঙালি মানস থেকে, যা আমার জীবনদর্শনের সঙ্গে সম্পূর্ন মানানসই।

অভিজিতের কয়েকটা লেখা পড়ে দেখলাম তাঁর লেখার মধ্যে আমার ভাবনাচিন্তাগুলো প্রতিফলিত হতে। আমি সমাজ পাল্টানোর স্বপ্ন দেখি কিন্তু অভিজিৎ সেটা শুধু কল্পনায় সীমাবদ্ধ না রেখে কাজে রূপান্তর করতে শুরু করেছিলেন। প্রচুর আফশোষ রয়ে গেল যে তাঁকে ধর্মের ছুতোয় অকালে সরিয়ে দিল যে বাঙালীগুলো তারা যে  নিজের জাতীর পায়ে কুড়োল মারল সেটা বোঝার সামর্থ্য তাদের নেই।

অভিজিতের খুন আমার সব ভাবনা চিন্তা মানসিকতাকে ঝাঁকিয়ে দিয়ে গেল। কিছুদিন আগে একটা লেখা দেখেছিলাম ব্লগ লেখা কিভাবে একটা হুজুগ থেকে এখন লুপ্তপ্রায়। অভিজিৎ প্রমান করে দিয়ে গেলেন সেটা কতটা ভুল। অভিজিতের কাজকে অসম্মান না করেই বলছি, স্বপ্ন দেখলেও হাতেকলমে সমাজ বদলানোর লড়াই চালানোর মত দৃঢ়প্রতিজ্ঞা, দুরদৃষ্টি, সময়, ত্যাগস্বীকার, বীক্ষা আমার নেই। আমি শখে লিখি অবসর সময়ে যা এখন প্রায় নেই বললেই চলে। কিন্তু যতটুকু লিখি সেখানে স্মৃতি অভিজ্ঞতার পাশাপাশি নিজের ভাবনাচিন্তাগুলোরও জায়গা করে দেয়া যা আমার নিজের জীবনবোধের প্রতিচ্ছবি, সেটা সম্পূর্ণ প্রাসঙ্গিক হয়ে দেখা দিল ২৬শে ফেব্রুয়ারীপ পর থেকে। অনেকক্ষেত্রেই এই জাতীয় লেখায় প্রসঙ্গটাই মুখ্য, যদিও লেখার ধার পাঠকদের আকর্ষিত করে আর সেটাও আকাঙ্খিত কিন্তু অপরিহার্য নয়।

তাই তখন থেকে ঠিক করলাম ব্লগ লেখা চালিয়ে যাবো, কাউকে বাধ্য করবনা ফেসবুকের মত ঘাড় ধরে পড়ানোর জন্য, কিন্তু লেখা চালিয়ে যাব। আগের যা পরিকল্পনা ছিল সেটা পাল্টাবোনা কিন্তু লিখবো সামাজিক রাজনৈতিক বিষয় নিয়েও বিশেষ করে যেখানে প্রসঙ্গগুলোর তাৎপর্য আমার কাছে অমুল্য। এর মাঝে ফেসবুকে ছোটখাট লেখায় বন্ধুরা উৎসাহ যুগিয়েছে তাদের ভাল লেগেছে বলে, সেটার গুরুত্বও কিছু কম নয়। কেউ পড়ে ভাল লেগেছে বললে সেটা লেখার তাগিদ বাড়াবে বটে কিন্তু সেটা না হলেও অন্তত একটা সন্তুষ্টি থাকবে যে ভবিষ্যতে পেছনের দিকে চাইলে দেখতে পাব এই লেখাগুলো যাতে জুড়ে থাকবে একটা প্রচ্ছন্ন গর্ববোধ যেটা এখন হয় আগের লেখাগুলো দেখে। এই প্রসঙ্গে এখানেই কলম থুড়ি কীবোর্ড থামালাম তবে আশা রাখবো যে উদ্যোগ নিয়ে শুরু করেছি সেটা বজায় থাকবে সপ্তা, মাসের গন্ডি ছাড়িয়ে বছরের দিকে…

Standard

One thought on “ব্লগ কেন লিখি

Leave a comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.