প্রায় এক দশক আগে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের প্রতিবাদ সমাবেশে তৎকালীন তৃণমূল সরকার পুলিশ ক্যাম্পাসে ঢুকিয়ে বীভৎস অত্যাচার চালায়। ইস্যুটা তখনও এক ছিল, কলেজ হোস্টেলে এক ছাত্রীর শ্লীলতাহানি। ছাত্রদের দাবি ছিল অপরাধীদের শাস্তি আর ভাইস চ্যান্সেলর এর পদত্যাগ। পুলিশ আর তৃণমূল তখনও প্রতিবাদ থামানোর যথেষ্ট চেষ্টা চালিয়েছিল, এবং তাতে মদত দিয়েছিলো তৃণমূলের ছাত্র শাখা। আন্দোলন অবশ্য থামেনি, এবং প্রায় ৬ মাস পর অবশেষে ভিসির পদত্যাগ ঘোষণা করা হয় মুখ্যমন্ত্রীর মাধ্যমে। যাদবপুরের ছাত্রছাত্রীদের অবস্থান হোককলরব নামে পরিচিতি পেয়েছিল।
আজ স্থান কাল অনেক পাল্টে গেছে। পাল্টায়নি সরকারের চোখরাঙানি, পুলিশের কারচুপি আর শাসক দলের গুন্ডামি। আজ আরও একবার শহর তোলপাড়, কারণ লোলুপ ধর্ষকদের শিকার এক প্রশিক্ষণরত তরুণী চিকিৎসক। অপরাধীরা ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয়নি, মেয়েটিকে খুন করে তার দেহ ছিন্নভিন্ন করে ফেলে রেখে যায়। এই ধুর্ষণ আর খুনের বীভৎসতার চেয়েও ঘৃণ্য আর জি কর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, কলকাতা পুলিশ আর তৃণমূল সরকারের আপ্রাণ চেষ্টা অপরাধীদের পরিচয় গোপন করার। প্রমান লোপাটের অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে, পুলিশ প্রথমে পুরো ঘটনাটাকে আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা করে, তারপর হাসপাতাল সুপারের বদলি যিনি সবুজ আবির মেখে ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসেন (এখনো বাসেন কিনা জানিনা), তারপর সেমিনার হল যেখানে চিকিৎসক ধর্ষিতা হয়েছিলেন তার মেঝের টাইল উপড়ে নেয়া হয়েছে মেইন্টেনেন্সের নামে। সাক্ষীসাবুদ বিলোপ করার ঘটনা আজ থেকে শুরু হয়নি। তবে এরকম নির্লজ্জভাবে প্রশাসনের সমাজবিরোধী আর খুনিদের অবাধ বিচরণের অধিকার দেয়া যে বাস্তবে সম্ভব তা আর জি করের ঘটনা না দেখলে অবিশ্বাস্য ছিল। তোলাবাজ সিন্ডিকেট, সমাজবিরোধী, গুন্ডাদের পৃষ্ঠপোষক সরকারের থেকে খুব বেশি কিছু আশা করা যায়না তবু এদের আচারব্যবহার দুকান কাটার চেয়েও নিকৃষ্ট।
আজ তাই রাতদখল। প্রশাসন যখন অকর্মন্য, সাধারণ মানুষকেই পথে নামতে হয়। নামতে হয়েছিল হোককলরবের সময়, যদিও সেটা ছাত্র সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, রাস্তায় নামতে হচ্ছে আজও, আরো সহস্রাধিক ঘৃণ্য অপরাধের বিচার চাইতে। আজ শুধু কলকাতায় নয়, গোটা বাংলায় মেয়েরা হাঁটবেন রাস্তায়, সুবিচারের আশায়, আশায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির, আশায় যে কোন মেয়ে যেন রাস্তায় বেরোতে পারেন নির্ভয়ে। প্রধানত নারীকেন্দ্রিক হলেও সামিল হবেন অনেকেই, নারী পুরুষ নির্বিশেষে। যেন কোনো রক্তলোলুপ পিশাচ আর না ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে একাকী মেয়েদের উপর, যেন মেয়েরাও সমান স্বাচ্ছন্দে রাস্তায় বেরোতে পারে। রাতদখল হয়ে উঠুক এই অন্ধকার শহরের বুকে একরাশ আলোর ঝলকানি।
তবু কিছু প্রশ্ন থেকে যায় মনে। এই জনসাধারণের সর্বতো সমর্থন এ কি শুধু ঘটনাটি ঘটেছে কলকাতার বুকে বলে? মানুষের মনুষ্যত্বের ওপর ভরসা থাকলে বলাই যায় জোর গলায় যে হ্যাঁ সবাই স্থান কাল পরিস্থিতি নির্বিশেষে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে। তবু সিনিক সত্তাটি বারবার মনে খোঁচা মেরে যায় – আসবে তো সবাই? রাতদখল শুধুমাত্র প্রতীকী প্রতিবাদ হয়ে যাবে না তো? এই লড়াই কিন্তু এক দিনের নয়। দুর্বৃত্তরা আজ লুকিয়ে তাদের কোটরে , প্রতিবাদ একদিন শেষ হবে, মানুষ আবার পথ চলবে একাকী, তখন কিন্তু তারা আবার বেরোবে তাদের পৈশাচিক নখদাঁত বের করে, আবার কোন মা বোন মেয়ের জীবন শেষ হয়ে যাবে অকালে, ক্ষমতালোভী প্রশাসন আবার টেনে নেবে এইসব কীটদের তাদের ছত্রছায়ায়। হয়তো আবারো বা হবে আর এক রাতদখল , কিন্তু যা হারাবে তা ফিরে আসবে না। রাতদখল তাই থামা চলবে না। রাতদখল শুধুমাত্র প্রথম পদক্ষেপ। প্রতিবাদ ততক্ষন চলতে থাকুক যতক্ষণ না এই দুর্বৃত্তরা এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকরা অনুধাবন করতে পারে যে তাদের গা জোয়ারি র দিন শেষ।
সরকার বলছে এই প্রতিবাদ রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট। মানুষ মাত্রেই রাজনৈতিক। কাজেই যদি কেউ অনুমান করে থাকেন যে এই রাতদখল শুধুমাত্র মনুষ্যত্বের খাতিরে তাহলে বলতে হবে যে সেরকম মানুষ বিরল। এই রাতদখল অভিযানে মামা টিমা সমর্থকরা সামিল হবেন কি? মনুষ্যত্বের খাতিরে আশা করাই যায় যে এই ঘৃণ্য অপরাধীদের শাস্তি চাওয়ার জন্যে প্রতিবাদে মানুষ তাদের রাজনৈতিক সত্তা ভুলে সর্বতোভাবে সমর্থন করবে। হয়তো কেউ কেউ করছেন, তাঁদের বাহবা। হয়তো অনেক সমর্থকই তাদের সরকারের এই আচরণে বিতৃষ্ণ কিন্তু লোকাল লিডারদের বিরাগভাজন হতে চাইছেন না। তাঁদের দ্বিধা থাকাটাও স্বাভাবিক, লোকাল দাদাদের আশীর্বাদ ছাড়া এ রাজ্যে কিছুই সম্ভব নয়। আবার অন্যদিকে বামপন্থীরা প্রবলভাবে সোচ্চার। তাঁরাও কি শুধু সমাজশোধনের জন্যেই সামিল হচ্ছেন নাকি দু চারটে লোকসভা বিধানসভা সিটের আশাও রয়েছে প্রচ্ছন্নে? আর গোবৎসল হিন্দুত্ববাদীরা? তারা যে শোরগোল করছে বলাই বাহুল্য তাদের মূল লক্ষ্য ২০২৬ বিধানসভা। ভুলে গেলে চলবে না যে যোগী আদিত্যনাথের রাজ্যে মহিলাদের সুরক্ষা দেশের মধ্যে নিকৃষ্টতম। রাতদখলকে হাতিয়ার করে যেন আবার সাম্প্রদায়িক দলেরা ফায়দা না তোলে।
অতএব কিংকর্তব্যম? রাজনীতি থাকুক রাজনীতির জায়গায়। আজ রাত শুধু হোক রাতদখলের। হোক সেই সব মেয়েদের যাঁরা চান যেন আর কোন মেয়েকে কর্মক্ষেত্রে দুষ্কৃতীদের শিকার না হতে হয়, হোক সেই সব মানুষদের যাঁরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নামবেন রাস্তায় এক নিরাপদ ভবিষ্যতের আশায়। অপরাধীরা কিন্তু আদপে ভীরু কাপুরুষ। তারা হানা দেয় দলবেঁধে একাকী মানুষদের ওপর। যেদিন মানুষ এক হবে সেদিন এদের পালাবার জায়গা থাকবেনা। পালাবার জায়গা থাকবেনা এই দুষ্কৃতীদের সরকারেরও। পাগল চটিটিসির। ভাইপোর। চটিচাটাদের। হিসেব একদিন হবেই। সেদিন খেলা হবে। মানুষ চিরকাল কোনঠাসা হয়ে থাকবেনা। আগুন একদিন জ্বলবেই। চাই শুধু একটা স্ফলিঙ্গ। সব ফুলকি থেকে আগুন জ্বলে না। রাতদখল হতেই পারে সে আগুন যা সব অন্যায়, অত্যাচার, অপরাধকে ছারখার করে দিতে পারে। আশায় রইলাম।
আর কয়েকটা মুহূর্তের জন্যে ভাবুন সেই দুর্ভাগা চিকিৎসক মেয়েটির কথা যে মানুষের সেবাকে নিজের জীবনের ব্রত করে নিয়েছিল, ভাবুন সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রমের পর একটু গা এলিয়ে দিয়েছিলো কয়েক মুহূর্তের জন্য, হয়তো ভাবছিলো পরের পেশেন্টের কথা, হয়তো ভাবছিলো ডিউটির পর অবসর সময়ে কি করবে, হয়তো দেখছিলো স্বপ্ন…. হঠাৎ
এখনো যদি পথে না নামেন তবে কবে নামবেন?