Durga puja, Nostalgia, short story

এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায় – দুই মাতালের ষষ্ঠী উদযাপন

এই কাহিনীর স্থান, কাল, পাত্র সম্পূর্ণ কাল্পনিক। যদি কেউ এই ঘটনার সাথে কোনো বাস্তবিক চরিত্রের সাযুজ্য খুঁজে পান তবে তা নিতান্তই কাকতালীয়।

এই কাহিনীর প্রেক্ষাপট কলকাতার অগুন্তি সরকারি আবাসনগুলির কোনো একটি। সেখানে দুর্গাপুজো হচ্ছে প্রায় গত বিশ বছর ধরে। খুব যে আড়ম্বর করে তা নয়, কিন্তু পুজোর অছিলায় পাড়ার প্রায় হাজার বাসিন্দা একজোট হয়ে কিছু একটা করার চেষ্টা করে যথাসাধ্য। পাড়ার মাঝে চত্বরে প্যান্ডেল হয় একটা, অনেকটা জায়গা জুড়ে, আর পুজোর পাঁচদিন কিছু না কিছু সাস্কিতিক পোগাম। কচিকাঁচাদের উৎফুল্লতা সবচেয়ে বেশি – নতুন জামাকাপড়, সাথে হাতখরচের কিছু পয়সা তা দিয়ে দেদার ফুচকা ঘুঘনি চালতা কুলের আচার, সময়মত বাড়ি না ফেরার চোখরাঙানি নেই, সব মিলে জমজমাট ব্যাপার। বয়স একটু বাড়লে তখন আবার এক-দু ঘন্টা আড্ডাও মারা যায় রাতের দিকে। সমস্যাটা হলো সাবালক হয়ে। উচ্চমাধ্যমিক দিয়ে ফেলা মানেই অনেকটা গুপী বাঘার মতো যা চাই পরতে খাইতে পারি যেথায় খুশি যাইতে পারি সানিধাপামাগারেসা গাইতে পারি অবস্থা। অনেকের এই সাবালকত্বে পদার্পন হয় নিতান্তই নিরাড়ম্বর ভাবে।তবে এই গল্পের গুপী বাঘা সে পথ মাড়ায়নি। মাড়ায়নি বলেই এ গল্পের অবতারণা।

জগাই আর মাধাই এই পাড়াতেই বড় হয়েছে। একসাথে খেলাধুলো ঝগড়াঝাঁটি মারপিট। দুজনেই সবে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে যে যার কেরিয়ার তৈরিতে ব্যস্ত। কে কি পড়ছে তা অপ্রাসঙ্গিক। তবে পাড়ার বাইরে বেরিয়ে দুজনেরই প্রচুর সদ্যপ্রাপ্ত সাবালকত্বের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়েছে বিগত ২ মাসে। সেগুলো একে অপরকে খুলে না বলতে পেরে দুজনেরই পেট ফুলে ফেঁপে উঠছে। এমন সময় হঠাৎ করে না বলে কয়ে দুর্গাপুজোর আগমন। তা দুজনেরই কলেজ আপাতত বন্ধ। দিনক্ষণ পাঁজি পক্ষ দেখে জগাই মাধাই ঠিক করলো ষষ্ঠীর দিন তারা বিকেল বিকেল পাড়া থেকে বেরিয়ে পড়বে, গন্তব্য এসপ্ল্যানেড। তখন মোবাইল ফোনের যুগ আসেনি, তাই খুটখুট করে মেসেজ করে যোগাযোগের চল ছিলোনা। কাউকে ডাকতে হলে হয় তার বাড়ি গিয়ে কড়া নাড়তে হবে, আর নিতান্তই আলসে হলে বাড়ির নিচে দাঁড়িয়ে হাঁক পাড়তে হবে। তবে এযাত্রা হাঁকডাক নৈব নৈব চ। বন্ধুবান্ধব কেউ জেনে গেলেই হয় ঘন্টার পর ঘন্টা কৈফিয়ত দিতে হবে নাহলে সব দঙ্গল মিলে একসাথে যেতে হবে।  প্ল্যানমাফিক তাই ষষ্ঠীর বিকেলে দুজনে মাঞ্জা মেরে বিশ্বকর্মা সেজে গুটিগুটি পাড়া থেকে বেরিয়েই ট্যাক্সি। স্কুলজীবনে যে তারা ট্যাক্সি চাপতনা তা নয়, তবে কলেজ মানেই অ্যাডাল্ট, তাই পিতৃদেবের হোটেলে খেয়েও পকেটে রেস্ত তখন অনেক বেশি। জগাইয়ের পরনে এক ধবধবে সাদা জামা, তার নাম আবার Fried Water. মাধাই পরেছে Van Heusen এর ফর্মাল জামা। কলকাতা তখনো অনেকটা কলকাতাতেই ছিল, জ্যামজট থাকলেও এসপ্ল্যানেড যেতে বিশেষ সময় লাগলোনা। লিন্ডসে স্ট্রিটে নেমে দুজনে ঢুকে পড়লো গ্লোব সিনেমার পানশালায়। হ্যাঁ, তখন সিনেমা হলে বার থাকতো, রেস্টুরেন্ট ও।

দুজনে মিলে একটা টেবিলে বসেই তৃষ্ণার্ত চাতক পাখির মতো আশেপাশের লোকজনের হাতে হাতে ঘোরা রঙবেরঙের গেলাসগুলো দেখে নিলো। কলেজ যাওয়া ইস্তক দুজনেরই বেশ কিছু জ্ঞান আহরণ হয়েছে এ বিষয়ে। কি ব্র্যান্ড, খেতে কেমন, কোন তরলের সাথে কি খাবার খেতে হবে। বিশেষ কালবিলম্ব না করে দুজনে ঠিক করলো গ্রীন লেবেল বলে এক তরুণ তুর্কি। এর মধ্যে খাবারের অর্ডার দিতে না দিতেই আশ্চর্য ব্যাপার। গ্রীন লেবেলের রিপ্রেজেন্টেটিভ স্ক্রাচকার্ড নিয়ে হাজির। সেসব ঘষে পাওয়া গেলো গিফট। যদিও জগাই মাধাই নিজেদের কীর্তিকলাপ খানিক ফুলিয়ে ফাঁপিয়েই বলেছিলো, তবু একটা ব্যাপার সেই প্রথম গিফট পাওয়া থেকেই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিলো, যে গ্রীন লেবেলের লোকটাকে বারে বারে তবু আসতেই হবে ফিরে। তা সে এসেছিলোও। ৭ বার। গ্রীন লেবেলের সোনালী রঙের ছোঁয়ায় সন্ধ্যে তখন সত্যিই সোনালী বর্ণ ধারণ করেছে। চিরুনি, পেন, কাপ, বেল্ট – টাকাকড়ি মিটিয়ে যখন তারা বার থেকে বেরোচ্ছে হাতে একরাশ গিফট নিয়ে, তাদের ভাবখানা ছিল যেন খেলার শেষে ম্যান অফ দ্য ম্যাচ প্রাইজ পেয়েছে। ওয়েটারের চোখে যেন ছিল খানিকটা বিস্ময় খানিকটা সম্ভ্রম, আশেপাশের টেবিলের গুঞ্জন আর আড়চোখে চাউনি যেন তাদের সেই অতিমানবিক প্রদর্শনীরই নীরব সমাদর। বাস্তব হয়তো ছিল সম্পূর্ণ আলাদা, তবে জগাই মাধাই তা জানেনা, ওদেরকে সেটাই ভাবতে দিন।

গ্লোবের বারে বসে এদিকে কারো খেয়াল হয়নি সময় কত হলো সেটা দেখার। আর সময়ের দামও তেমন ছিলোনা যে ঘনঘন ঘড়ি দেখতে হবে। কিন্তু কটা বাজে সে খেয়াল হতেই দুজনের নেশা খানিকটা চটকে গেলো। মোটে সাড়ে ৮টা। পাড়ায় তার মানে পোগাম চলছে পুরোদমে, জগাই মাধাই দুজনেরই বাবা মা তার মানে পাড়ায়।  খানিক সময় নষ্ট করার অভিপ্রায়ে ওরা এসে ভিড়লো দু পা হেঁটে নিউ এম্পায়ার সিনেমা হলে। তাদের বার-কাম-রেস্টুরেন্ট ওপরতলায়, সেখানেও একবার ঢুঁ মারা হয়ে গেলো জগাই মাধাইয়ের। ঢুকুঢুকু দু পেগ হুইস্কি মেরে আবার ঘড়ির দিকে চাওয়া। সময় যেন কাটতেই চাইছেনা। সবে তখন বাজে ৯টা। দুই বন্ধু কোনোমতে চৌরঙ্গীর রাস্তা টপকে ঢুকে পড়লো ময়দানে। ময়দান ঘুটঘুটে অন্ধকার আর রাস্তার উল্টোদিকেই ঝলমলে এসপ্ল্যানেড। নেশাটা যেন একটু চড়ছে। আলাপে ঢুকে পড়ছে শীর্ষেন্দু সুনীল কলেজ ভবিষ্যৎ। একটু জিরিয়ে নিতে দুজনে বসেপড়লো ঘাসের ওপর। ঠিক জুৎ হচ্ছেনা। জগাই এলিয়ে পড়লো হেমন্তের শিশিরে ভেজা ঘাসের ওপর, খানিক পর  মাধাইও। নেশাটা যেন একটু দেরি করে চড়ছে। মোটে পৌনে ১০টা।

তবু ফেরার চেষ্টা করতে হবে। পুজোর বাজারে গাড়ি পাওয়া দায়। বহু ড্রাইভার দুই মাতালকে নিয়ে কলকাতার কুখ্যাত এলাকায় যেতে বিশেষ উৎসাহ দেখালোনা। অবশেষে এক দয়ালু চালক জগাই মাধাইয়ের সরকারি আবাসনের থেকে কিঞ্চিৎ আগে অবধি নিয়ে যেতে রাজি হলো। হেঁটে পাড়ায় ফেরার সাধ্য কারোরই নেই তখন, অগত্যা রিকশা ভরসা। পারে ফেরা মানে ষষ্ঠীর রোমাঞ্চকর অভিযানের সেখানেই ইতি, তাই জগাই মাধাই মনের আনন্দে গান ধরলো।মাধাই সিটে বসে, জগাই পাদানিতে ঝুলতে ঝুলতে।

এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায়

Gilbey’s Green Label – সোনালী সন্ধ্যার অনুঘটক
Source: Quickcompany.in

গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারতো। দুজন চুপচাপ জর্দা পান খেয়ে গুটিগুটি বাড়ি ঢুকে ঘুমিয়ে পরদিন বন্ধুদের বলতে পারতো তাদের কান্ডকারখানা। কিন্তু বিধি বাম। আসল গল্পের শুরু তো এখান থেকেই। রাত সাড়ে ১০টা -১১টা। পাড়ার মুখে বসা গণশক্তির ষ্টল পেরিয়ে, পচা ডোবা পেরিয়ে রিক্সা এসে থামলো মণ্ডপের সামনে। গান কিন্তু তখন থামেনি। …”এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায়”…পাদানি থেকে গড়িয়ে নামলো জগাই…”এ কি বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু”…ভাড়া মিটিয়ে একে অন্যের গায়ে ঠেকা দিয়ে জগাই মাধাই মর্ত্যে পদার্পন করলো। মণ্ডপে ঢুকে গুটিকয় চেয়ার বিছিয়ে আরাম করে বসে দুজনে চারপাশটা একটু জরিপ করে নিলো। কেউ সন্দেহ করেনি তো? মন্ডপ আর তার আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জনাবিশেকের মাঝে তখন এক থমথমে নিঃস্তব্ধতা। নাঃ সব স্বাভাবিক।খালি দুজনের বন্ধুবান্ধব বাদে। বিনেপয়সায় তামাশা দেখার সুযোগ পেলে সবাই খানিক ডেঁয়ো পিঁপড়ের মতো ছেঁকে ধরে, তেমনি এবেলাও তার ব্যতিক্রম হলোনা।

সবাইকে সব বিস্তারে বর্ণনা করে গিফট দেখাতে গিয়েই হলো প্রথম গুগলি। কোথায় গিফট, কোথায় কি? সেই বার থেকে বেরোনোর সময় কোঁচড়ে করে যত গিফট নিয়ে বেরিয়েছিল জগাই আর মাধাই, সে সব পড়ে আছে ময়দানে। আবার ফিরে যাবে কি তারা, ফেলে আসা জিনিসগুলোকে কুড়িয়ে আনতে? না, তারা পাগল নয়, মাতাল মাত্র। কিন্তু বন্ধুবান্ধব পরিবেষ্টিত হয়ে, সারা সন্ধেবেলাটা পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করেও তাদের মনে খানিকটা খেদ রয়ে গেছিলো। কোথাও না কোথাও একটা খামতি রয়ে গেছে। তাই জগাই গিয়ে মাঝবয়েসী টেনিদার সামনে চেয়ার টেনে বসে ঠোঁটে আলতো করে একটা ক্লাসিক সিগারেট ঝুলিয়ে বললো, আগুন হবে? টেনিদা হঠাৎ বিষম খেয়ে পাড়ার বয়োজ্যেষ্ঠ কানুবাবুকে বলল বাড়ি চলেন। জগাই সিগারেট ধরিয়ে ফুড়ুৎ করে খানিক ধোঁয়া ছেড়ে দুটো চেয়ার নিয়ে মণ্ডপে প্রতিমার পাশে গ্যাঁট হয়ে বসলো। মাধাই আবার খানিক পালোয়ান টাইপ। তার খানিক পাঞ্জা না খেলে ঘুম আসবেনা। সে এবার ওপাড়ার রিজুর সাথে একদফা মারপিট করে নিলো। যাকে বলে আসর জমজমাট।

জগাই তারপর যখন চোখ খুললো তার বদ্ধ ধারণা হলো সে মারা গেছে। চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার, ছোট্ট এক চিলতে এক বেঞ্চ। মাথাব্যথা। হাতড়ে হাতড়ে আলো জ্বেলে আরেক আশ্চর্য ব্যাপার। সে রয়েছে একটা গুমটি ঘরে আর ঘরের ভেতর আরো ২-৪ জন অচেনা লোক। চোখের চশমা গায়েব, ঘড়ি নেই হাতে, মানিব্যাগ টাও হাপিস। ঘরে কনকনে ঠান্ডা। মরেই যখন গেছি, খানিক ঘুমিয়ে নেয়া যাক আগে, ভাবলো জগাই।

সপ্তমীর সকালে ৭টা নাগাদ হুঁশ ফিরলো তার। গুমটি ঘরটা থেকে বেরিয়েই পড়লো। আরে এ তো পাড়ার ক্লাবঘর। পেটে চরম খিদে এদিকে টাকাকড়ি সব গায়েব, শেষে টিউকল থেকে গাদাখানেক জল খেয়ে ল্যাজ গুটিয়ে বাড়ি ফিরলো জগাই। পরনের Fried Water তখন সবুজ আর কালোর মাঝামাঝি রঙে দাঁড়িয়েছে। ঘন্টা চারেক আরো ঘুমিয়ে আমতা আমতা করে কোথায় ছিল রাতে, জামার কি করে ওই দশা হলো এসব বিবৃতি দিয়ে বাড়ি থেকে যখন বেরোলো, মাধাই তখন অঞ্জলি দিতে নেমে পড়েছে। জগাইয়ের সব জিনিসপত্র ওর বাড়িতেই গচ্ছিত ছিল। এতক্ষনে দুজনেরই সাবালকত্ব প্রাপ্তি হয়েছে, এক রাত্রির ঘটনার জেরে। মাথা হেঁট করে, বকাঝকা খেয়ে, মাঝে কেউ এসে আবার প্রণামও ঠুকে দিয়ে গেলো – দুজনে প্রতিজ্ঞা করলো আর কখনো তামসিক ফুর্তি করবেনা। অনেক লোকসান। সেই প্রতিজ্ঞা বজায় ছিল অনেকদিন। অষ্টমী অবধি।

এরপর বহু বছর গড়িয়ে গেছে। তবু দুর্নাম রয়েই গেছে। ওই এক রাত্রির জেরে পাড়ায় যারা তাদের চিনতোনা সবাই হয়তো জেনে গিয়েছিলো ওদের দুজনের নাম। জগাই মাধাইকে একসাথে দেখলেই বন্ধুরা বলত আজ কি খেল দেখাবি। চুইং গাম খেতে খেতে পাড়ায় ঢুকলেই জিজ্ঞাসা কি খেয়ে এলি। এখন আর অত লুকোছাপা নেই। জগাই মাধাই কেউই থাকেনা পাড়ায় বহু বছর। তবু পুজোর সময় পাড়ায় দুজনকে দেখলেই লোকে আজও মনে করিয়ে দেয় পঁচিশ বছর আগের সেই সোনালী সন্ধ্যার কথা। জগাই মাধাইয়ের মনে চাগিয়ে ওঠে হারিয়ে যাওয়া গিফটগুলোর জন্যে একদলা মনখারাপ। আর মনে পড়ে যায় সেই পুরোনো সুর –

এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায়

Advertisement
Standard

2 thoughts on “এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায় – দুই মাতালের ষষ্ঠী উদযাপন

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.